অধরা গডফাদার ১০ কাউন্সিলর
অপকর্মে জড়িতদের অবস্থান শনাক্তে মাঠে গোয়েন্দারা
আলমগীর হোসেন
|
অধরা গডফাদার ১০ কাউন্সিলর অবৈধ কাসিনো, বিভিন্ন সেক্টরের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ এলাকাভিত্তিক নানা অপকর্মের গডফাদার হিসেবে পরিচিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত ১০ কাউন্সিলর এখনও অধরা। যাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বা সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদে নেতৃত্বের পরিচয়। একদিকে প্রভাবশালী নেতা, আরেক দিকে কাউন্সিলরÑ এই দুটি পরিচয়েই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নানা অবৈধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ‘রামরাজত্ব’ গড়েছে এসব স্থানীয় গডফাদাররা।
স্থানীয়রা বলছেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফুটপাথ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক-জুয়াসহ সবকিছুরই নিয়ন্ত্রক তারা। যাদের কেউ কেউ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসারও হোতা হিসেবে পরিচিত। অবশ্য ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর এই গডফাদারদের অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ক্যাসিনো ও টেন্ডারবাজি বড় বিষয় নয়, যেখানেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হবে সেখানেই অভিযান চলবে। স্থানীয় পর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অবৈধ ক্যাসিনো, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের গডফাদার হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেফতার হলেও এসব স্থানীয় পর্যায়ের গডফাদার কাউন্সিলররা ভয়ঙ্কর নানা অপকর্ম করেও এখনও অধরা রয়ে গেছে। এরই মধ্যে শুধু গত শনিবার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ বিদেশি অস্ত্র ও বিপুল মদসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকার (৩৩ নম্বর ওয়ার্ড) কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব ওরফে সুলতান। তবে আরও অন্তত ১০ জন এমন কাউন্সিলর এখনও গ্রেফতার হয়নি। যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে নানা অপকর্মের অভিযোগ। তারা হলেনÑ যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুবলীগ নেতা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক সাঈদ, ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছাত্রলীগ নেতা মো. আনিসুর রহমান, ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আশ্রাফুজ্জামান, ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোস্তফা জামান ওরফে পপি, ২০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদউদ্দিন আহম্মেদ রতন, ২২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তরিকুল ইসলাম সজীব, ৩০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হাসান ওরফে পিল্লু, ৩৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবাশে^র হোসেন চৌধুরী ও ২৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরান। এসব কাউন্সিলরের বাইরেও রাজনৈতিক দলের আরও অনেকেই মিলেমিশে সিন্ডিকেট আকারে এলাকাভিত্তিক নানা অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করছে বলেও জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুবুল আলম সময়ের আলোকে বলেন, অবৈধ ক্যাসিনোসহ নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান চলমান রয়েছে। ক্যাসিনোর বাইরেও যারা সন্ত্রাসবাদ, অস্ত্র, মাদক ও চাঁদাবাজির মতো অপকর্মে জড়িত তাদের সবার বিষয়েই তথ্যানুসন্ধান চলছে। যারা এসবে জড়িত তাদের গ্রেফতারের পাশাপাশি র্যাব এসব বিষয়ে সার্বক্ষণিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর পরই এই কাউন্সিলরদের অধিকাংশই অন্তরালের চলে যায়। ক্যাসিনো ব্যবসায়ী আলোচিত যুবলীগ নেতা কাউন্সিলর সাঈদসহ কয়েকজন ইতোমধ্যেই সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে চলে গেছে। কেউ কেউ দেশে থাকলেও লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান করছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ জুয়ার আসর, ক্যাসিনো পরিচালনা, মাদক ব্যবসা, ফুটপাথ নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন সেবা সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে এসব কাউন্সিলর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এলাকার বিভিন্ন ক্লাব, সামাজিক সংগঠন, বিভিন্ন মার্কেট ও ফুটপাথ নিয়ন্ত্রণে নেয় তারা। এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী স্পোর্টিং ক্লাবগুলোকে খেলাধুলা থেকে অনেকটা দূরে রেখে অনেকেই শুরু করে অবৈধ ক্যাসিনো ও জুয়ার আসরসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। বর্তমানে ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত সবচেয়ে বেশি আলোচিত কাউন্সিলর হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ডিএসসিসির ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাব খাটিয়ে তিনি এলাকার সব ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্যাসিনোসহ জুয়ার আসর গড়ে তোলেন। রাজধানীর ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করতেন সাঈদ। এর বাইরেও আরও অন্তত তিনটি ক্লাবে তার পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অংশীদারিত্ব ছিল। এছাড়া সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডেও সাঈদের ক্যাসিনো ব্যবসা রয়েছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ডিএসসিসির ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আনিসুর রহমান ওরফে আনিসের বিরুদ্ধে এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কাউন্সিলর আনিস খিলগাঁও, বাসাবো, সবুজবাগ, মুগদাসহ আশপাশ এলাকায় প্রায় সব ধরনের অপকর্মের হোতা হিসেবে পরিচিত। মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায় পরোক্ষভাবে তার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব অপকর্মের মাধ্যমে তিনিও বিপুল টাকা ও সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। তবে এ বিষয়ে কাউন্সিলর আনিসের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ডিএসসিসির ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আশ্রাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে আরামবাগ ও সবুজবাগ এলাকার একাধিক ক্যাসিনো ও জুয়ার আড্ডা নিয়ন্ত্রকের অভিযোগ রয়েছে। তিনি যুবলীগ নেতা কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদেরও ঘনিষ্ঠজন। এদিকে পল্টন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ডিএসসিসির ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোস্তফা জামান পপির বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে পল্টন, গুলিস্তান, কাকরাইল, শান্তিনগর, মৌচাক ও মালিবাগসহ আশপাশ এলাকার সব ফুটপাথ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। এসব ফুটপাথ থেকেও বিপুল পরিমাণ অঙ্কের চাঁদাবাজি হয়ে থাকে বলে জানা গেছে। এছাড়া এসব এলাকায় ব্যক্তি পর্যায়ে নতুন স্থাপনা করতে গেলেও পপির ‘অনুমোদন’ লাগে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ডিএসসিসির ২০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদউদ্দিন আহমদ রতনের বিরুদ্ধেও ক্যাসিনো কারবারসহ, ঠিকাদারি তথা টেন্ডারবাজিরও অভিযোগ রয়েছে। ২২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা তরিকুল ইসলাম সজীবের বিরুদ্ধে রয়েছে তার এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের শেল্টার ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির অভিযোগ। তিনিও ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। ডিএসসিসির ৩০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান ওরফে পিল্লুর নিয়ন্ত্রণে চলে পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটসহ আশপাশ এলাকা। এসব এলাকার মালবাহীসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন থেকে তিনি বিপুল পরিমাণ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিএসসিসির ৩৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জুর বিরুদ্ধেও ওয়ারী-টিকাটুলি এলাকায় চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এই চাঁদাবাজির টাকা আদায়ে রয়েছে তার বেশকিছু অনুসারী। টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেট ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেটের দেড় হাজারের বেশি দোকান থেকে মাসে বিপুল অঙ্কের টাকা আয় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১১ সাল থেকে তিনি এই দুটি মার্কেটের সভাপতি। তবে সেটি ‘স্বঘোষিত’ বলেও জানা গেছে। এলাকায় চাঁদাবাজি, ক্যাসিনো ও জুয়ার আড্ডাসহ বিভিন্ন অপরাধে তিনি জড়িত বলে জানা গেছে। ডিএনসিসির ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোবাশে^র হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধেও ক্যাসিনো কারবারসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ডিএনসিসির ২৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরানের বিরুদ্ধে তেজগাঁও ও ফার্মগেট এলাকায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তিনি ক্যাসিনোর সঙ্গেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ফার্মগেট-তেজগাঁও এলাকায় টেম্পো স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে কাউন্সিলর ইরানসহ অধিকাংশের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। |