১৯৭৫ থেকে ২০০৪
অভিশপ্ত আগস্টে বাঁচা মরার লড়াইয়ে বেঁচে যাওয়া আজকের বাংলাদেশ
আবু জুবায়ের
|
একজন বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির দূত নয় তিনি গোটা পৃথিবীর নির্যাতিত, পরাধীন মানুষের স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহনের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি শুধুই বাংলাদেশের মানুষের নেতা নন তিনি সমগ্র পৃথিবীর আইডোলজির নেতা। সেই মানুষটির সাথেই ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে ভোরের সূর্য উদয়ের আগেই বাংলার আলোকিত সূর্য এবং সূর্যের ভবিষ্যৎ সকল প্রজন্মকে চিরতরে বন্দুকের গুলিতে ঝাঝড়া করে দিয়েছিলো বাংলাদেশে জন্মগ্রহন করা এবং শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলার হাওয়া, বাতাস খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা সেই মোশতাকের দল। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জন্ম হলেও ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে সেই বাংলাদেশের আবারো মৃত্যু ঘটেছিলো। দেশ চলে গিয়েছিলো নমরুদদের হাতে। সেদিন বাংলার সূর্যসহ তার বংশ পরমপরার সূর্য অস্তমিত হয়ে গেলোও দুই সূর্যের প্রখর কিরণকে তারা অস্তমিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সেই দিনই আরও তিন সূর্যের প্রখর কিরণ, অপ্রতিরোধ্য, আপোষহীন নেতা এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান হেনাসহ জাতীয় তিন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেদিন শেখ মুজিবের এমন করুণ মৃত্যুর পর তাদের গ্রেফতার করাই ছিল তাদের আত্মার অপমৃত্যু কারণ তাদেরও যেকোন সময় মেরে ফেলা হবে সেটা বুঝতে তাদের বেগ পেতে হয় নাই। ঘাতকরাও জানত তারা শেখ মুজিবের অত্মা। তারা বেঁচে থাকতে আপোষ করবেন না, তারা মুজিব হত্যার কঠিন প্রতিশোধ নিবেন। শেখ মুজিব সহ এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান হেনাদের জন্মই হয়েছিল এই বাংলার মানুষের মুক্তির দূত হয়ে। দেশের ভৌগলিক সীমার বাহিরে থাকার দরুন সেদিন বেঁচে যাওয়া সূর্যের আর একজন আজকের আরেক বাংলাদেশ, জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সকল রক্তচক্ষুর লোহিত আগ্নেয়গিরির শিখার উত্তাপে পুড়ে যেতে পারেন জেনেও সংগ্রামী, আপোষহীন পিতার যোগ্য সন্তান সেই নমরুদদের লেলিহান শিখা উপেক্ষা করে ফিরে এসেছিলেন শেখ মুজিবের বাংলায়। সকল ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে যখন তিনি তার বাবার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে সোচ্চার হয়েছিলেন। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং নরপশু দেশদ্রোহী নমরুদদের বিষের কাটা হয়ে দাড়ালেন ঠিক তখনি বেঈমান বাবার উত্তরসূরী সূত্রে কালো রক্তের বিষে জন্ম নেওয়া দেশদ্রোহী তারেক রহমান বাবার মতই আরেক পচাত্তরের ম্যাপ একেছিলেন ২১ শে আগস্ট।সেদিন বাংলাদেশ তথা জননেত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে গিয়েছিলেন। যে অল্প কজন বিদেশি সাংবাদিক ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যার ঘটনায় রিপোর্ট করেছিলেন, মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ তাদের ভিতর অন্যতম একজন। গত চার দশকে ১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বেশকিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন তিনি, যেগুলোর প্রত্যেকটি ঐ কালোরাতের প্রকৃত ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক নতুন দিকের উন্মোচন করেছে আমাদের সামনে। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ-এর সাবেক এই দক্ষিণ এশীয় প্রতিনিধি এবং গার্ডিয়ানের নিয়মিত লেখক তার নীচের লেখাটিতে আরও একবার ১৫ আগস্টের এক অজানা অধ্যায়ের দরজা উন্মোচন করেছেন। যা এই উদঘাটন অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে আমাদের ধারণা পালটে দিতে বাধ্য। ঘটনাটা ছিল ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের ঠিক আগে: তখনকার ঢাকার কূটনৈতিক মহলে এক ভদ্রলোকের অনেক বন্ধু ছিল। ব্যবসার খাতিরেই এসব মানুষের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব এবং সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মার্কিন দূতাবাসে তখন তার একজন বন্ধু ছিল। এক রাজনৈতিক কর্মকর্তা। তার নাম ফিলিপ চেরি। তার কথায়, ফিলিপ চেরি ছিলেন এক সুদর্শন ও চমৎকার ব্যক্তিত্বের মানুষ। বাংলাদেশের জন্য তার মনে অনেক ভালোবাসা। মাঝে মাঝে তার গাড়িতে করে চেরিকে নিয়ে যেতেন নিজের কারখানাগুলোতে। ফিল চেরির মুখে বারবার শোনা যেত, বাংলাদেশ কি সুন্দর একটা দেশ! ১৯৭৫ সালের জুলাইয়ের শেষে কিংবা আগস্টের শুরুতে ফিলিপ চেরি ওই ভদ্রলোককে ফোন করে বলেন, তিনি তার বাড়িতে একটি নৈশভোজের আয়োজন করতে পারেন কিনা। ভদ্রলোক সানন্দে রাজি হলেন। ভদ্রলোক চেরি জিজ্ঞাস করলেন তিনি কি নির্দিষ্ট কাউকে আমন্ত্রণ করতে চান? চেরি তাকে বলল, সে কেবল একজন অতিথিকে আমন্ত্রণ করতে চান এবং তার স্ত্রীসহ। সেই অতিথি ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়া। ভদ্রলোক জেনারেল জিয়াকে চিনতেন। তিনি জানালেন, ওই নৈশভোজ আয়োজন করতে পারলে তিনি খুশিই হবেন। চেরি কয়েকটি সম্ভাব্য তারিখের কথা বললেন। নৈশভোজের আয়োজন হলো। জেনারেল জিয়া তার স্ত্রী খালেদাসহ সেখানে পৌঁছালেন। ফিলিপ চেরিও তার স্ত্রীসহ সেখানে গেলেন। ওই নৈশভোজে এই তিন দম্পতির বাইরে আর কেউ ছিলেন না। অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহ আগে নৈশভোজটি আয়োজিত হয়েছিল। দুই অতিথি তার বাড়িতে পৌঁছানোর পরপরই পরিষ্কার হয়ে গেলো, তারা নিজেদের মধ্যেই আলাপ করতে এসেছে। জেনারেল জিয়া ও ফিলিপ চেরি বাগানের ভেতরে গেল এবং খাবার পরিবেশনের আগ পর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলল। জিয়া ও চেরিকে দেখে মনে হলো তারা একে অপরের চেনা। নৈশভোজের পর তারা আরেকবার বাগানে গেল এবং আলোচনা করতে লাগল। ওই সময়ে দেখে মনে হয়েছিল তারা গালগল্প করছে। অবশ্য অভ্যুত্থানের পর ভদ্রলোক ও তার পরিবারের উপলব্ধি হয় যে তাদের ব্যবহার করা হয়েছিল। অভ্যুত্থানের পরদিন ভদ্রলোক এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি গাড়ি চালিয়ে গুলশানে ফিলিপ চেরির বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে এক নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। তার চোখে ছিল ক্ষোভের অশ্রু। তিনি প্রশ্ন করতে থাকেন, কীভাবে এমনটা হল। বারবার বলেন, ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তার নিজের মায়ের মতো ছিলেন। তারা তাকে মেরে ফেলেছে। কেন? পুরো পরিবারকে হত্যা করা নিয়ে তিনি ক্ষুদ্ধ ও মর্মাহত ছিলেন। বারবার জানতে চাইছিলেন, ‘কীভাবে এমনটা হলো?” চেরির স্ত্রী তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল, তাকে চা দিয়েছিল। চেরি তাকে বলছিল, “আমি জানি তুমি ওই পরিবারের খুব কাছের মানুষ ছিলে।” রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্যবসায়ী ভদ্রলোক চলে যান। এরপর তিনি আর চেরির দেখা পাননি। তাদের পরিবার রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তারা জানেন, জিয়া-চেরির সেই ডিনার কোনও সামাজিক সাক্ষাৎ ছিল না। তারা ভালো করেই বুঝেছিলেন, সামরিক অভ্যুত্থানের সময় জিয়ার ভূমিকা কী ছিল, ১৫ আগস্ট মেজর ফারুক ও মেজর রশিদের সেই হত্যাকাণ্ড সংঘটনের সময় সেনাবাহিনীকে তাদের বাধা দেওয়া থেকে বিরত রাখতে তিনি কী করেছিলেন। অনেকেই বুঝতে পেরেছিল যে অভ্যুত্থানে জিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জেনারেল জিয়া বিরোধিতা করলে এই অভ্যুত্থান সম্ভবই ছিল না। তথ্য-প্রমাণ থেকেও বোঝা যায়, অভ্যুত্থানে মূল কারিগরের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জিয়া। খন্দকার মুশতাক আহমেদের চেয়ে তার ভূমিকাই বড় ছিল। লেখক: কার্যনির্বাহী সদস্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ
|