নাগরিক চিন্তা- চেতনায় লেপে থাকা সোঁদা মাটির সুবাসের নাম আল মাহমুদ
তাজিমুর রহমান
|
কারও চোখে কবিতার রাজপুত্র, কেউ মনে করেন তিনি অনন্য গন্তব্যের সিন্দবাদ। আবার অনেকের কাছে বিষ্ময়কর এক প্রতিভা। কবি আল মাহমুদ সম্পর্কে এই কথাগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত সে বিতর্কে না ঢুকে বলা যায় আধুনিক বাংলা কবিতার একজন স্বতন্ত্র ও লোকজ ভাবনার অন্যতম কবি হলেন আল মাহমুদ। যার কলমে বাংলা কবিতা হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ নতুন স্বরের এবং মৌলিক। ত্রিশের দশকের বাংলা কবিতা প্রবনতার ধারায় (পশ্চিমা অনুসরণ) অন্য কবিবন্ধুদের মতো ভাসলেন না কবি আল মাহমুদ। বরং বাংলা কবিতাকে বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যে রূপবতী করে তুললেন তিনি। তাই তার কবিতার মূল এসেন্স হয়ে উঠলো ভাটি বাংলার জনজীবন, চরাঞ্চলের জীবনচাঞ্চল্য, গ্রামীণ সৌন্দর্য আর নর-নারীর চিরন্তরন প্রেম বিরহ। যেন নাগরিক চিন্তা ও চেতনায় লেপে দিতে চাইলেন মাটির সোঁদা গন্ধ। একদিকে জসিম উদদিন আর একদিকে জীবনানন্দ এই দুই বরেণ্য কবির লোকজ আবহ রূপায়ণ জগত থেকে বেরিয়ে এলেন কবি আল মাহমুদ। সম্পূর্ণ আধুনিক এবং মৌলিক স্বরে নিজের কাব্যক্ষেত আঁকলেন। ফলে তিনি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে হয়ে গেলেন আন্তর্জাতিক। কবি গোলাম মুরশিদ বলেছেন, “জসিম উদ্দিন যেখানে লোক সাহিত্যের উপাদান এর উপর তাঁর কুটির তৈরি করেন, আল মাহমুদ সেখানে আধুনিক এক প্রাসাদের কারুকার্যে লৌকিক উপাদান ব্যবহার করেন। আর কবির এই লোকজ ভাবজগৎ তাঁর প্রথম দিকের কাব্যগুলিতে বেশি করে স্পষ্ট । তবে তাঁর সার্থক সৃষ্টি তথাশ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’র বেশিরভাগ কবিতায় এ ভাবনা বেশি করে প্রোথিত। বিশিষ্ট সমালোচক বোরহান উদ্দিন জাহাঙ্গীর-এর কথায়, ‘... বাঙালি কবি,আবহমান মানুষ, ইতিহাসের মধ্যে হৃদয়ের ইতিহাস গেঁথে দিয়েছেন। জনপদ, শস্য, হৃদয়, সবই এক মহাসত্যের বিভিন্ন দিক। আর শব্দ আবহমনা, চিরকালীন গ্রামীণ ও লোকজ।’ আর এই কাব্য সম্পর্কে কবি নিজস্ব উপলব্ধি ছিল,- “সোনালি কাবিনের শব্দগুলো আমি এ মাটির গন্ধ থেকে আহরণ করেছি, ব্যবহার করেছি। ভাটি বাংলার মানুষের মুখের ভাষাকে আমি আধুনিকতায় জাগিয়ে দিতে চেয়েছি এবং দিয়েছি। যা ‘সোনালী কাবিন’ ধরে রেখেছে তার বুকে।” কবি আল মাহমুদ। আসল নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ। ১১জুলাই ১৯৩৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম। শুধুমাত্র কবিতার প্রতি টানে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। খদ্দরের পিরহান ও পাজামা পরিহিত কবি সঙ্গে এনেছিলেন একটা সুটকেস। কিন্তু তার হৃদয়ে ভরা ছিল আস্ত একটা বাংলাদেশ। তাঁর নিজের কথায়- “আমার স্যুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী,পাখি, পতঙ্গ, নর -নারী সহ বহমান এক আস্ত বাংলাদেশ।” কবির এই বক্তব্যের সূত্র ধরে বুঝতে পারি তাঁর কাব্যের ভাবজগৎ বহুমাত্রিক হলেও মুল সুরটি নিহিত আছে বাংলাদেশের আবহমান লোকজীবনের ছোঁয়ায়। তাই তো কবি বলেন, “ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে কোমল ধানের চারার ওয়ে দিতে গিয়ে ভাবলাম, এ মৃত্তিকা কিষাণী আমার। (প্রকৃতি)” কিংবা যখন বলেন, “ফিরলে আজো পাবো কি সেই নদী স্রোতের তোড়ে ভাঙা সে এক গ্রাম? হায়রে নদী খেয়েছে সব কিছু জলের ঢেউ ঢেকেছে নাম -ধাম।” (এক নদী ) এই দুটি কবিতাংশ থেকে সহজেই বোঝা যায় কবির কলমে কি সুন্দর ভাবে গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যময় লৌকিক উপাদান উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাই হয়তো বলতে দ্বিধা নেই গ্রামীণ সৌন্দর্য বিন্যাসে (লোকজ উপাদান) আল মাহমুদ একটি নিরাময়ের নাম। শান্ত, শুভ, নরম দেশজ শব্দের প্রতি কবির চিরকাল পক্ষপাত। একমাত্র কথা সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ -এর গ্রামীণ জনজীবন বর্ণনার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে তাঁকে। আবার কবি আল মাহমুদের এই ভাব লোকের সঙ্গে এ বাংলার নিভৃতচারী কবি মণীন্দ্র গুপ্তের অনেকাংশে সাদৃশ্য আছে বললে ভুল হবে না। ‘ ‘লোক লোকান্তর’ কাব্যের ‘তিতাস’ কবিতায় কবি আল মাহমুদের উচ্চারণ, “অদূরে বিল থেকে পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, বক পাখার জলের ফোঁটা ফেলে দিয়ে উড়ে যায় দূরে;”। কিংবা ‘কালের কলস’ কাব্যের “প্রত্যাবর্তন” কবিতায়, “দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি, নারী উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি”। প্রতিটি লাইনে এই গ্রামীণ সৌন্দর্য বর্ণনায় কবি যেন ডুব দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলে এনেছেন লোকজ রতœসম্ভার। যা তাঁর অনবদ্য প্রকাশভঙ্গিমায় অনন্য । ‘সোনালী কাবিন’ গ্রন্থের সনেটগুচ্ছতে বিষয়বস্তুর ভিন্নতা আছে ঠিকই। তবে একেবারে লৌকিক উপাদান ছিন্ন নয়। কিন্তু অন্যান্য কবিতাগুলোর মধ্যে লোকজ (গ্রামীণ ঐতিহ্য) উপাদানের সঙ্গে কবির আক্ষেপ লগ্ন থাকলেও বেশি করে প্রতীয়মান হয় লৌকিক অনুষঙ্গ। বিশেষ করে প্রকৃতি, দায় ভাগ, প্রত্যাবর্তনের লজ্জা, স্বপ্নের সানুদেশে, তোমার হাতে, নতুন অব্দে,পালক ভাঙার প্রতিবাদে খড়ের গম্বুজ, কবিতা এমন প্রভৃতি কবিতাগুলোতে। ‘কবিতা এমন’ কবিতায় কবির উপলব্ধি- “কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধ ভরা ঘাস ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা ডাক্তার।” আবার ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতায় দেখি , “তোমাকে বসতে হবে এখানেই এই ঠা-া ধানের বাতাসে। আদরে এগিয়ে দেয়া হুঁকোটাতে সুখ টান মেরে তাদের জানাতে হবে কুহলি পাখির পিছু পিছু কতদুর গিয়েছিলে পার হয়ে পানের বরজ!” এখানে পাখি, হাঁসের ডিম, ঘাস, বাছুর, চিঠির প্যাড, পানের বরজ প্রভৃতি অনুষঙ্গগুলি আমাদের চিরচেনা গ্রামীণ ক্যানভাস তুলে আনে। আল মাহমুদের কলমের ছোঁয়ায় তা যেন হয়ে উঠেছে অপরূপ। চির সবুজের কবি আল মাহমুদ এভাবে তার কবিতা পরিক্রমায় গ্রামীণ জীবন আর লোকজ উপাদানকে আধুনিকায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। সমালোচক আবিদ আনোয়ার এর কথায়, “আধুনিকতায় লোকজ উপাদানের ব্যবহার সূচিত হয়েছিল চল্লিশ দশকের কবি আহসান হাবীবের হাতে। আর আল মাহমুদ একে ব্যাপকতা দান করেছেন এবং বিষয়টিও তার নিজস্বতা অর্জনের অন্যতম উপাদান।” আর এই নিজস্বতা অর্জনের মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতায় চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন। তাঁর কবিতার আবেদন তাই কখনো শেষ হবে না। লোকজ উপাদান সমৃদ্ধ কবিতাগুলির আবেদন থাকবে চিরকালীন।
|